বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ০১:১৫ অপরাহ্ন
মং সোয়াইদুল্লাহ:
পশ্চিম মিয়ানমারের ‘এনগা ইয়েন্ট চেঞ্জ’ গ্রামের বাসিন্দা আমি। সেখানে একটি সুখী, শান্তিময় শৈশব ছিল। বাবার ছিল সমৃদ্ধ দোকান। আম, নারকেল ও কলা গাছে ঘেরা একটি প্রশস্ত আঙিনার বাড়িতে থাকতাম আমরা। আমি, বাবা-মা এবং ছয়জন ছোট ছোট ভাইবোন। আমার শৈশবে কোনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেখিনি। মুসলিম হলেও প্রতিবেশী রাখাইনদের সঙ্গে বড় কোনো সমস্যা ছিল না। পাশের রাখাইন গ্রামে অনেক বন্ধু ছিল। গ্রামের মাঠে আমাদের দেখা হতো। আমরা ‘চিনলোন’ খেলতাম। অনেক মজা করতাম। আশা ও আনন্দে ভরা সুন্দর জীবন আজ কেবল অস্তপারের স্মৃতি। ছয় বছর ধরে সীমান্তের ওপারের বাংলাদেশের কক্সবাজার নামক একটি শরণার্থী শিবিরে বাস করছি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির বোধহয় এটাই। লক্ষাধিক মানুষ গাদাগাদি করে বাঁশ ও তেরপলি নির্মিত ক্ষুদ্র আশ্রয়ে মাথা গুঁজে আছে। প্রতিটি মুহূর্ত যেন সংগ্রামের। পর্যাপ্ত খাবার বা বিশুদ্ধ পানি তেমন থাকে না। প্রায়ই আগুন লাগছে, খুন হচ্ছে।
কীভাবে এখানে এসে পৌঁছলাম?
এর পেছনে দায়ী ফেসবুক এবং প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ। তারা পরিস্থিতি উস্কে দিয়েছে, ফলে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী আমাদের ওপর হামলে পড়েছে। তার পেজগুলো রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তুলতে সহায়তা করেছে। ফেসবুকের অ্যালগরিদম ভুল তথ্য প্রচার করেছে, যা একসময় বাস্তব সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। যদিও মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের উত্তেজনার ইতিহাস আজকের নয়। কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, ‘স্মার্টফোন ও ফেসবুক’ আমাদের জীবনে প্রবেশ না করা পর্যন্ত এবং রাজনীতিবিদ ও ধর্মান্ধরা ঘৃণাত্মক বক্তব্য না ছড়ানো পর্যন্ত দুই জাতির মধ্যে নিত্যনৈমিত্তিক শত্রুতা অন্তত ছিল না।
ফেসবুক যে ঘৃণার হাতিয়ার হতে পারে, ২০১২ সালে প্রথম বুঝেছি। আমার বয়স তখন এগারো। একদল রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে বৌদ্ধধর্মী এক মেয়েকে ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগ ওঠে। সেই জঘন্য অপরাধের সুরাহা তখন হয়নি। কোনো প্রমাণও ছিল না। তবু সমগ্র সম্প্রদায়ের ওপর দোষ চাপানো হয়। বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য ফেসবুক পোস্ট হতে থাকে। রাখাইন প্রতিবেশীদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব শীতল হতে শুরু করে।
২০১৬ সাল নাগাদ ফেসবুকে রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাব বাড়তে থাকে। ফলে তা নিপীড়নকে উৎসাহিত করে এবং বৈধতা দেয়। বিষয়টি আমার পরিবারে সরাসরি প্রভাব ফেলে। বাবা এবং কয়েকজন সচ্ছল রোহিঙ্গা থানায় হামলা করেছেন বলে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করা হয়ে। বড়সড় জরিমানার মুখে পড়েন তারা। জরিমানা না দেওয়ায় চাচা আবু সুফিয়ান ও তার ছেলে বুশাকে গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে কারাগারে পাঠানো হয়। ততদিনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ও ধর্মবিদ্বেষী পোস্ট ফেসবুকে অহরহ চলছে। ‘দেশ বাঁচাতে এবং অবৈধ বাঙালিদের তাড়াতে সমবেত হওয়ার আহ্বান’ জানানো পোস্টগুলো আমি নিজে দেখেছি। রাখাইন বন্ধুদের সঙ্গে ‘চিনলোন’ খেলার দিন শেষ হয়ে গেল। এমন প্রতিটি পোস্টে আমি রিপোর্ট করেছি, কিন্তু ফেসবুক কিছুই করেনি। উল্টা দাবি করেছে যে, উদ্দেশ্যমূলক এসব ঘৃণ্য পোস্ট এবং বার্তাগুলো নাকি ‘(ফেসবুকের) কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড লঙ্ঘন করে না।’
এরপরই শুরু হয় হত্যাকাণ্ড। হামলা শুরু হয়, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সকালের দিকে। তখন বয়স আমার মাত্র ১৫। ভালো ছাত্র ছিলাম। আইনজীবী হওয়ার আশা। এসএসসি পরীক্ষার পড়ার চাপ ছিল, তাই খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেছি। হঠাৎ শুনি গুলির শব্দ। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ঘরেই থাকলাম। আওয়াজ চলল প্রায় ৩ ঘণ্টা। ততক্ষণে মিলিটারি চলে এসেছে। বাইরে বের হয়ে দেখি, বাজারের দোকান মালিক মোহাম্মদ শামীমের লাশ পড়ে আছে রাস্তায়। অভিযানের সময় নিরাপত্তা বাহিনী গ্রামের বিভিন্ন স্থানে বিস্ফোরক রেখে দেয়। বিপদ সম্পর্কে আমরা সচেতন ছিলাম না। হোসেন আহমেদ নামে গ্রামের একজন বোমায় পা দেয় এবং চোখের সামনেই বিকট বিস্ফোরণে সে মারা যায়। ভয়ে অনেকে জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ে। বেশ কয়েকটি পরিবার পরদিনই বাংলাদেশে যাত্রা করে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বাড়িতেই থাকব।
সামরিক বাহিনী গ্রামের অবশিষ্ট সকলকে রেড ক্রিসেন্ট অফিসের কাছে একটি মাঠে জড়ো হওয়ার নির্দেশ দেয়। আমরা যাইনি। নিশ্চিত ছিলাম, গেলে তারা আমাদের মেরে ফেলবে। শুনেছি, অন্য গ্রামে তারা রোহিঙ্গাদের জবাই করছে। গ্রাম ছেড়ে তাই অন্য গ্রামে পরিবার এবং বন্ধুদের সঙ্গে কয়েক রাত থাকি। এক ফাঁকে বাড়ি ফিরে দেখি, কোথাও কেউ নেই। সর্বত্র সহিংসতার লক্ষণ ছড়ানো। অনেককে হত্যা করা হয়েছে।
মিয়ানমারে আর নিরাপত্তা নেই বুঝে পায়ে হেঁটে বাংলাদেশের পথ ধরি। চলতে চলতে দেখি অগণিত মৃতদেহ পড়ে আছে পরিত্যক্ত গ্রামে, রাস্তায়, ধানক্ষেতে। বেশির ভাগ বাড়িঘর পুড়ে গেছে। ঠাণ্ডা ও বৃষ্টি মাথায় জঙ্গল-পাহাড় পেরিয়ে দিনভর হাঁটতে থাকি আমরা। কয়েকদিন খাইনি। ১৫ দিন পরে বাংলাদেশে পৌঁছি। ফেসবুকই আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে। শুধু আমরা রোহিঙ্গারা নয়, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পর্যন্ত বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও বিভ্রান্ত ও ঘৃণাত্মক কন্টেন্ট রোধ করতে তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এই দায় কি তাদের নিতে হবে না? স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে আমাদের সহায়তা করা কি তাদের দায়িত্ব নয়? জাকারবার্গসহ যারা ফেসবুক পরিচালনা করেন, আমাদের দেখতে কি তারা কক্সবাজারে একবার আসবেন? এটা কি অপরিহার্য নয়? শরণার্থী শিবিরে কয়েক রাত কাটিয়ে তারা দেখুক, আমরা কেমন আছি, কী নিদারুণ অবস্থায় আছি। তখন বুঝবেন, আমার এবং আমার লোকদের সঙ্গে কী করেছে তারা। হতে পারে, তখন তারা আমাদের সহযোগিতার জন্য কিছু করবেন। গণহত্যায় প্রাণ হারিয়েছেন যারা ফেসবুক তো তাদের ফিরিয়ে দিতে পারবে না। মিয়ানমারে খুইয়ে আসা আমাদের জীবন ও সম্পদও তারা উদ্ধার করতে পারবেন না। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তাদের কিছুই করার নেই। জাকারবার্গ কি কক্সবাজারে আমার মতো তরুণদের শিক্ষায় অর্থায়ন করার সামর্থ্য রাখেন না? নিশ্চয়ই রাখেন। আমাদের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে তিনি এগিয়ে আসতে পারেন। তার কোম্পানি আমার যে ক্ষতি করেছে, অন্তত এইটুকু করলে খানিকটা হয়তো লাঘব হবে।
লেখক : বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী
আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর : মনযূরুল হক